ভারতের সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলন: (Armed revolutionary movement in India).

ভারতের সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলন: (Armed revolutionary movement in India).

ভূমিকা:

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলনের নয়, বরং এতে আছে অগণিত তরুণ বিপ্লবীর রক্ত, ত্যাগ ও সাহসের গাথা। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যখন দেশ অহিংস পথে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করছিল, তখনই একদল তরুণ বিশ্বাস করতেন— “অস্ত্রধারণ ছাড়া স্বাধীনতা অসম্ভব।” এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় ভারতের সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলন। এরা ছিল দেশপ্রেমে উদ্বেলিত সেই যুবকরা, যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলন ও যুবশক্তির পরিবর্তন:

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী হঠাৎ করেই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
এই সিদ্ধান্তে ভারতের তরুণ সমাজ গভীরভাবে হতাশ হয়। তারা বুঝতে পারে যে শুধুমাত্র নীতিগত প্রতিবাদ বা অহিংস পথ ধরে ইংরেজদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। ফলে অসহযোগ আন্দোলনের পর থেকেই বিপ্লবী তরুণেরা হাতে তুলে নেয় অস্ত্র, এবং তারা এক নতুন অধ্যায় রচনা করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে।

বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ:

বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই (১৯০৫ খ্রিঃ) বিপ্লবী চিন্তাধারার সূচনা হয়েছিল, কিন্তু ১৯২০-এর দশকে তা আরও শক্তিশালী রূপ নেয়। বিভিন্ন সংগঠন গঠিত হয়, যাদের লক্ষ্য ছিল—
ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আঘাত হেনে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন।

সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য কার্যকলাপ:

১. টেগার্ট হত্যার চেষ্টা (১৯২৩ খ্রিঃ):

১৯২৩ সালে বাংলার বিপ্লবীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য রাজনৈতিক ডাকাতি শুরু করেন। সেই সময় কলকাতার পুলিশ প্রধান ছিলেন চার্লস টেগার্ট, যিনি বিপ্লবীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতেন। তাঁকে হত্যার দায়িত্ব নেন বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা। কিন্তু ভুলবশত তিনি অন্য এক ইংরেজ পুলিশ অফিসারকে হত্যা করেন। এই ঘটনায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গোপীনাথ সাহার বীরত্ব ও আত্মবলিদান তখনকার যুবসমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

২. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৫ খ্রিঃ):

এই সময় একদল বিপ্লবী ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HRA)’ গঠন করেন।
সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, অশফাকুল্লাহ খান, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। তাঁরা অস্ত্র কেনার অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯২৫ সালে কাকোরি এক্সপ্রেস ট্রেন ডাকাতি করেন। এই ঘটনার জন্য পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং একটি ঐতিহাসিক মামলা শুরু হয়— ‘কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে। বিচারে চারজন বিপ্লবীকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্যদের দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনাই ছিল ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম বড় সংগঠিত প্রচেষ্টা।

৩. নওজওয়ান ভারত সভা ও বিপ্লবী ঐক্য (১৯২৫ খ্রিঃ):

১৯২৫ সালে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, সুখদেব, যশপাল প্রমুখ তরুণ বিপ্লবী গঠন করেন ‘নওজওয়ান ভারত সভা’। এর লক্ষ্য ছিল যুব সমাজকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। পরে ১৯২৮ সালে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA)’। এই সংগঠন ভারতের সমাজতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের মূলমন্ত্র ছিল — “স্বাধীনতা ও সমাজের পুনর্গঠন।

৪. স্যান্ডার্স হত্যা (১৯২৮ খ্রিঃ):

১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশি লাঠিচার্জে আহত হয়ে মারা যান লালা লাজপত রায়। এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও চন্দ্রশেখর আজাদ লাহোরে পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন (১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮)। এই ঘটনায় ইংরেজ সরকার ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীদের সাহসিকতা ভারতের যুবসমাজে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়।

৫. লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯ খ্রিঃ):

১৯২৯ সালের এপ্রিলে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কাউকে হত্যা করা নয়, বরং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি প্রতিবাদ জানানো। তাঁরা নিজেরাই গ্রেফতার হন এবং আদালতকে বিপ্লবের মঞ্চে পরিণত করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হয়।
মামলার রায়ে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁদের আত্মবলিদান ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

৬. অলিন্দ যুদ্ধ (১৯৩০ খ্রিঃ):

১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত সাহেবের ছদ্মবেশে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করেন। তাঁরা কারা বিভাগের প্রধান সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে আত্মবলিদান দেন। এই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এটি ছিল শহুরে অঞ্চলে সংঘটিত এক সাহসী বিপ্লবী অভিযান।

৭. চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০ খ্রিঃ):

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, মাস্টারদা সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা গঠন করেন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। তাঁর সহযোগী নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত প্রমুখ সাহসী বিপ্লবী চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার আক্রমণ করেন।
তাঁরা শহরের টেলিগ্রাফ অফিস, রেলস্টেশন ও অস্ত্রাগার দখল করেন এবং ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দেন।
যদিও পরে পুলিশ এই আন্দোলন দমন করে, তবুও এই অভিযান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকে।

সশস্ত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ও প্রভাব:

সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন প্রাণসঞ্চার করে।
এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে ভারতীয়রা কেবল নীরব ভোগী নয়, বরং প্রয়োজনে অস্ত্র তুলে নিতে পারে। বিপ্লবীদের ত্যাগে দেশের যুবসমাজ অনুপ্রাণিত হয়, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়ে যায়, এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন দিক পায়। ভগৎ সিং, সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার— এই নামগুলো আজও ভারতের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে আলো ছড়ায়।

উপসংহার :

ভারতের সশস্ত্র-বিপ্লবী আন্দোলন ছিল সেই অধ্যায়, যেখানে স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ, সাহস ও আদর্শ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রতিটি রক্তবিন্দু ভারতের স্বাধীনতার বীজ হয়ে কাজ করেছে। ভগৎ সিং-এর হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে ওঠা কিংবা সূর্য সেনের নৃশংস মৃত্যুও বৃথা যায়নি—
তাঁদের আত্মবলিদানই ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পথ সুগম করে দেয়। তাঁরা হয়তো আর নেই, কিন্তু তাঁদের অমর আত্মা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়— “দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া কখনো বৃথা যায় না।”

GKnotebook.in সাধারণ জ্ঞান ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য একটি তথ্যসমৃদ্ধ ওয়েবসাইট। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং শিক্ষকতা করি। এখানে শিক্ষার্থীরা GK, Current Affairs, এবং পরীক্ষামুখী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত নোটস পেয়ে থাকে।

Post Comment

error: Content is protected !!