সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: sannyasi-fakir-rebellion-in-bengal.

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: sannyasi-fakir-rebellion-in-bengal.

বাংলায় কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ও বিহারের দরিদ্র কৃষকেরা অন্ন ও বস্ত্রের জন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ধ্বজা তোলেন। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ের ফকির এবং পূর্ববঙ্গ ও ময়মনসিংহের ‘গিরি’, ‘গোঁসাই’ এবং ‘নাগা’ সন্ন্যাসীরা প্রথম এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। পরে ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, ছাঁটাই হওয়া সৈনিক ও বিতাড়িত কৃষক এ বিদ্রোহে যোগ দেয়।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন।
এই বিদ্রোহের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, কৃপানাথ, মুশা শাহ, মজনু শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলি শাহ প্রমুখ অন্যতম।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে ভবানী পাঠকের মৃত্যু হয়।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ:

সমকালীন বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র থেকে এইসব বিদ্রোহের যে সব কারণগুলি জানা যায় তা নিম্নে দেওয়া হলো —

  1. বাংলা ও বিহারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে করতে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকে কৃষকে পরিণত হয়; ইংরেজরা তাঁদের উপর শোষণপীড়ন চালায়।
  2. তীর্থযাত্রার উপর ইংরেজদের আরোপিত কর তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
  3. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ)-এর সময় ইংরেজদের পৈশাচিক শোষণ ও অত্যাচার বিদ্রোহীদের আস্থা নষ্ট করে দেয়।
  4. কোম্পানির ধার্য করা অত্যধিক রাজস্ব ও জমি থেকে কৃষক উচ্ছেদ কৃষকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি করে।
  5. রাজস্ব আদায়ের নামে কোম্পানির লুণ্ঠন ও অত্যাচার বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
  6. রেশম ব্যবসায় কোম্পানির বাধা দেওয়াও ফকিরদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিস্তার:

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়।
ক্রমে তা দাবানলের মতো মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
অত্যাচারিত দরিদ্র কৃষক, মোগল সেনাবাহিনীর বেকার সৈন্য এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী ও ফকিররা এতে যোগ দেয়।

উইলিয়াম হান্টার সর্বপ্রথম এই বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেন, যদিও লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস একে “হিন্দুস্থানের যাযাবর ও পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব” হিসেবে আখ্যা দেন।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের প্রকৃতি:

  • এটি ছিল মূলত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক-ভিত্তিক আন্দোলন
  • ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার একে “কৃষক বিদ্রোহ” বলে আখ্যা দেন।
  • লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস একে “যাযাবর ও ডাকাতদের উপদ্রব” হিসেবে উল্লেখ করেন।
  • সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এই বিদ্রোহের পটভূমি অঙ্কিত করেছেন।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ফলাফল:

  • বিদ্রোহ সামরিকভাবে ব্যর্থ হলেও এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পূর্বাভাস
  • সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় চেতনার সূচনা ঘটায়।
  • ভবিষ্যতের বিপ্লবী আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।

উপসংহার:

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল বাংলার মাটিতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বৃহৎ ও সংগঠিত আন্দোলন। যদিও এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, তবু এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বিদ্রোহে সাধারণ কৃষক, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও দরিদ্র জনগণ একত্রিত হয়ে ইংরেজ শাসনের শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তাদের রক্ত ও ত্যাগই পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ প্রমাণ করেছিল যে বাংলার মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে জানে, আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাদের রক্তে মিশে আছে।

GKnotebook.in সাধারণ জ্ঞান ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য একটি তথ্যসমৃদ্ধ ওয়েবসাইট। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং শিক্ষকতা করি। এখানে শিক্ষার্থীরা GK, Current Affairs, এবং পরীক্ষামুখী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত নোটস পেয়ে থাকে।

Post Comment

error: Content is protected !!