নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তি (১৯৫০): পটভূমি, বিষয়বস্তু ও ফলাফল: nehru-liyaqat-pact-1950-analysis-bangla.

নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তি (১৯৫০): পটভূমি, বিষয়বস্তু ও ফলাফল: nehru-liyaqat-pact-1950-analysis-bangla.

ভূমিকা:

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলেও এর সঙ্গে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা— দেশভাগ। ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হওয়ার ফলে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গা, সম্পত্তি লুণ্ঠনবিপুল পরিমাণে জনবসতি স্থানান্তর ঘটে। পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সদ্য স্বাধীন ভারত এই বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যায় চরম সংকটে পড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান-এর মধ্যে এক ঐতিহাসিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, যার ফলশ্রুতিতেই ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল স্বাক্ষরিত হয় ‘নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তি’ বা ‘দিল্লি চুক্তি’

নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তির বিষয়বস্তু:

এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল — দুই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান। চুক্তির প্রধান বিষয়গুলো নিম্নরূপ—

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ:

চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নাগরিকরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে। সংখ্যালঘুদের উপর যদি কোনো নির্যাতন বা সমস্যা দেখা দেয়, তবে সেই রাষ্ট্রই তাদের সমস্যার সমাধান করবে—অন্য দেশ এতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না।

শরণার্থীদের সাহায্য ও নিরাপত্তা:

পূর্ববাংলা, পশ্চিমবাংলা ও আসাম অঞ্চলে বহু মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছিল। চুক্তিতে বলা হয়, যে কেউ অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে যেতে চাইলে, উভয় দেশই তাদের সহায়তা করবে এবং নিরাপদে পারাপারের ব্যবস্থা করবে।

সংখ্যালঘু কমিশন ও অনুসন্ধান কমিটি গঠন:

চুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে, যা সংখ্যালঘুদের অবস্থা ও অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করবে। পাশাপাশি উদ্বাস্তু সমস্যার কারণ ও সংখ্যা নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।

মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি:

চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাখা। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের মতামত ও স্বার্থ রক্ষা করা।

সম্পত্তি ও ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ:

চুক্তিতে বলা হয় যে, দেশত্যাগী বা সংখ্যালঘু জনগণের সম্পত্তি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে এবং কোনো নাগরিককে জোরপূর্বক ধর্মান্তর বা নির্যাতনের শিকার হতে দেওয়া যাবে না।

পারস্পরিক সহযোগিতা ও শান্তি স্থাপন:

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারস্পরিক সহযোগিতা ও আস্থা বজায় রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। দুই দেশের সরকার জনগণের মধ্যে শান্তি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।

প্রতিক্রিয়া:

এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর অনেক মহলে হতাশা দেখা দেয়। বিশেষত ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ড. ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী মনে করেছিলেন যে চুক্তিটি যথেষ্ট দৃঢ় নয় এবং এর মাধ্যমে উদ্বাস্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এই কারণেই তাঁরা নেহরুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। সাধারণ জনগণের মধ্যেও চুক্তি সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়— কেউ একে শান্তির প্রয়াস হিসেবে স্বাগত জানায়, আবার কেউ একে দুর্বল পদক্ষেপ হিসেবে সমালোচনা করে।

নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তির ফলাফল ও প্রভাব:

চুক্তি কার্যকর করার পরও বাস্তবে উদ্বাস্তু সমস্যার যথাযথ সমাধান হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন অব্যাহত থাকায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শরণার্থীদের প্রবাহ বন্ধ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে এই শরণার্থীদের আগমন অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে—

  • তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়,
  • নগর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়,
  • কর্মসংস্থানের সংকট ও সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

তবে প্রধানমন্ত্রী নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর ধরে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কর্মসূচিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাই ভারতের ইতিহাসে এই সময়কালকে যথার্থই বলা হয় “পুনর্বাসনের যুগ”

উপসংহার:

সবশেষে বলা যায়, ১৯৫০ সালের দিল্লি বা নেহরু–লিয়াকৎ চুক্তি দুই দেশের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার এক আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনাস্থা, প্রশাসনিক জটিলতা ও সীমান্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন অব্যাহত থাকায় চুক্তিটি কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তবুও এটি ছিল ভারত–পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চুক্তি, যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের এক ঐতিহাসিক প্রয়াস হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

GKnotebook.in সাধারণ জ্ঞান ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য একটি তথ্যসমৃদ্ধ ওয়েবসাইট। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং শিক্ষকতা করি। এখানে শিক্ষার্থীরা GK, Current Affairs, এবং পরীক্ষামুখী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত নোটস পেয়ে থাকে।

Post Comment

error: Content is protected !!