ওয়াহাবী আন্দোলন: কারণ, বিকাশ ও ফলাফল (Wahhabi movement)
ভূমিকা:
ভারতে ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভিক যুগে মুসলমান সমাজ আর্থিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটিয়ে ইংরেজরা যখন ভারতের উপর তাদের আধিপত্য কায়েম করে, তখন মুসলমানদের রাজত্বের অবসান ঘটে। মুসলমান শাসন থেকে ইংরেজ শাসনে এই পরিবর্তন তাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গভীর প্রভাব ফেলে।
ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভিক প্রভাব:
মুসলমানদের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি
ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর বহু মুসলমান তাদের জীবিকার পথ হারায়। বিচারব্যবস্থায় মুসলমানদের যে প্রভাব ছিল তা ক্রমে বিলুপ্ত হয়। ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা চালু হওয়ায় তারা শিক্ষাগত দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ে।
তাদের কাছ থেকে জমিজমাও কেড়ে নেওয়া হয়। ইংরেজ আধিপত্য মুসলমানদের মনে অতীত রাজত্বের স্মৃতি ফিরিয়ে আনত, যা তাদের মানসিকভাবে ইংরেজ শাসনের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে।
মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়া ও মানসিকতা:
ধর্মীয় কঠোরতা বৃদ্ধি
ইংরেজ শাসনের প্রতি অসন্তোষের ফলে মুসলমান সমাজ নিজেদের ইসলামি ধর্মশাস্ত্র বা শরিয়তের নিয়মে পরিচালিত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে হিন্দুদের বহু সামাজিক প্রথা মুসলমান সমাজে ঢুকে পড়েছিল, যা শরিয়তের বিরোধী ছিল। ফলে মুসলমান পণ্ডিত বা মৌলবীরা ধর্মসংস্কারের ডাক দিতে শুরু করেন।
আবদুল ওয়াহাব ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা:
আবদুল ওয়াহাবের মতবাদ
আঠারো শতকের মধ্যভাগে আরবদেশে আবদুল ওয়াহাব “ওয়াহাবী আন্দোলন” নামে এক বিশাল ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন।
এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মকে কোরআন ও শরিয়তের বিশুদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা।
ওয়াহাবী মতবাদের মূল তত্ত্বসমূহ
- ইসলামকে কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- মৃতের দরগায় পূজা বা ধূপদীপ দেওয়া নিষিদ্ধ।
- ধূমপান, অলংকার ব্যবহার ও রেশমী বস্ত্র পরিধান ইসলামবিরোধী।
আবদুল ওয়াহাব নিজের মতবাদের প্রচারে তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করেও এগিয়ে যান। তিনি সাময়িকভাবে মক্কা দখল করলেও পরবর্তীতে বিতাড়িত হন।
ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের বিস্তার:
সৈয়দ আহম্মদের ভূমিকা
ভারতে ওয়াহাবী মতবাদ প্রচার করেন রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদ। তিনি আরব থেকে ফিরে এসে ভারতে এই ধর্মীয় আন্দোলন সংগঠিত করেন।
প্রথমে উত্তর প্রদেশ, পরে পাটনা ও কলকাতায় তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। উলায়েৎ আলি ও এনায়েৎ আলি তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন।
আন্দোলনের চরিত্র ও উদ্দেশ্য
যদিও ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে ভিত্তিক, তবুও তা ক্রমে রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে।
ওয়াহাবীদের মতে, ইংরেজ শাসনে ভারত “দার-উল-হারব” (অমুসলিম শাসিত দেশ) হয়ে পড়েছে।
অতএব ইংরেজদের উৎখাত করে দেশকে আবার “দার-উল-ইসলাম” বা ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
ওয়াহাবী আন্দোলনের সম্প্রসারণ ও সংগ্রাম:
দেশীয় রাজাদের সহযোগিতা চাওয়া
সৈয়দ আহম্মদ দেশীয় রাজাদের কাছ থেকেও সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন।
তিনি শিখ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন এবং পেশোয়ার অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
কিন্তু ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে শের সিং-এর হাতে তিনি নিহত হন।
আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্ব
সৈয়দ আহম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর দুই শিষ্য উলায়েৎ আলি ও এনায়েৎ আলি আন্দোলনের নেতৃত্ব নেন।
তাঁরা আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আন্দোলন জোরদার করেন।
বাংলা, বিহার ও হায়দ্রাবাদেও এই মতবাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলন ও তিতুমীর:
তিতুমীরের ভূমিকা
ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও অনেকের মতে তিতুমীরের আন্দোলন ছিল ওয়াহাবী আন্দোলনেরই একটি শাখা।
হান্টার সাহেব বলেন, তিতুমীর ছিলেন বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলনের নেতা।
সৈয়দ আহম্মদের সঙ্গে তিতুমীরের সাক্ষাৎ হয়েছিল, এবং তিনি তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।
কৃষক বিদ্রোহ না ওয়াহাবী আন্দোলন?
তবে অধ্যাপক বিনয় চৌধুরীর মতে, তিতুমীরের আন্দোলন মূলত ছিল জমিদার ও নীলকর-বিরোধী কৃষক আন্দোলন, যদিও তাতে ধর্মীয় প্রভাব ছিল।
এই কারণে তিতুমীরের আন্দোলনকে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ওয়াহাবী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি
আন্দোলনের পতন
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরও ওয়াহাবী আন্দোলন কিছুদিন সক্রিয় ছিল।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মিট্টানা অঞ্চলে তারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে, কিন্তু ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল পারভোক ইংরেজ বাহিনী দিয়ে ওয়াহাবীদের পরাজিত করেন।
১৮৬৫ সালের মধ্যে পাটনা অঞ্চলের ওয়াহাবীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
ওয়াহাবী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ:
- যেসব অঞ্চলে আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল, সেখানকার স্থানীয় উপজাতিরা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি।
- আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল দূরবর্তী পাটনা; ফলে রসদ সরবরাহ ও যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়ে।
- ইংরেজ সামরিক শক্তির তুলনায় ওয়াহাবীরা দুর্বল ছিল।
- অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলে।
উপসংহার:
ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম দিকের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জাগরণের প্রতিফলন।
যদিও এটি ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তবুও এর প্রভাব ভারতীয় মুসলমান সমাজে গভীরভাবে পড়ে।
এই আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য, রাজনৈতিক চেতনা ও আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তুলেছিল, যা পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।



Post Comment